মেয়র লিটনের দুর্নীতির দুর্গ:
সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট, খুন, ভোট ডাকাতি—বেনাপোল পৌরসভার ১৫ বছরের অন্ধকার রাজত্ব বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য প্রবেশদ্বার বেনাপোল—যেখানে প্রতিদিন অজস্র ট্রাক, কোটি কোটি টাকার পণ্য যাতায়াত করে। সেই শহরের পৌর প্রশাসনের চালকের আসনে গত ১৫ বছর ছিলেন আশরাফুল আলম লিটন। আর ঠিক এই সময়েই বেনাপোল শহর রূপ নেয় এক দুর্নীতিবান্ধব সন্ত্রাসের দুর্গে।
স্থানীয়রা বলেন, “এটা আর পৌরসভা ছিল না, ছিল এক ব্যক্তির একচ্ছত্র শাসনের সাম্রাজ্য।” টেন্ডার, টোল, উন্নয়ন প্রকল্প, এমনকি খুনের অভিযোগও উঠেছে এই মেয়রের বিরুদ্ধে।
১. কোটি টাকার টার্মিনাল ও টোল সিন্ডিকেট:
২০২৩ সালের ১৬ মার্চ—বেনাপোল সচেতন নাগরিক কমিটির আয়োজনে শহরে এক বিরাট বিক্ষোভ হয়। মূল অভিযোগ:
পৌর ট্রাক টার্মিনাল ও টোল ইজারার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ।
“উন্নয়নের নামে লুট হয়েছে পৌর রাজস্ব। শহরকে গরিব রেখে মেয়র হয়েছেন ধনী।” — আন্দোলনকারীদের মন্তব্য
অথচ আজও পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি। বরং অভিযোগকারীদের অনেকে নানা ধরনের হুমকির শিকার।
২. ভুয়া উন্নয়ন প্রকল্প ও বিল কেলেঙ্কারি:
রাস্তা, ড্রেন, মার্কেট, ফ্লাডলাইট—সবই নথিতে আছে। মাঠে নেই।
স্থানীয়রা বলছেন:“বিলটা ঠিকমতো হয়, শুধু কাজটাই হয় না!”সার্ভে অনুযায়ী, শেষ পাঁচ বছরে ১০০+ প্রকল্পের মধ্যে ৪৭টির কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
৩. রাশেদ–আমিরুল বাহিনী: লিটনের রাজনৈতিক ভিত্তি
মেয়র লিটনের রাজনীতির গোড়ায় ছিল রাশেদ ও আমিরুল নামক দুই কুখ্যাত সন্ত্রাসীর বাহিনী।
বিশ্লেষকরা জানান, লিটন নিজেই ছিলেন তাদের ক্যাডার। পরে সেই একই বাহিনীকে ব্যবহার করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হন ‘প্রধান মাস্তান’ হিসেবে।
৪. পুট খালির নাসির সেলটার কানেকশন:
বেনাপোল বন্দরের কুখ্যাত সন্ত্রাসী নাসির। তার 'সেলটার দাদা' হিসেবে পরিচিত ছিলেন মেয়র লিটন। বন্দর এলাকার জমি দখল, চাঁদাবাজি ও ট্রাক পার্কিং সিন্ডিকেটে এই ‘দাদা’র ভূমিকা ছিল মুখ্য।
৫. তুহিন হত্যা মামলা:
২০১৯ সালের আলোচিত তুহিন হত্যা মামলায় লিটনের নাম উঠে আসে।
অভিযোগকারীরা দাবি করেন:“পরিকল্পনা থেকে কিলিং মিশন সবকিছুতেই লিটনের সংশ্লিষ্টতা ছিল।”মামলাটি এখনও তদন্তাধীন থাকলেও, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
৬. আকুল বাহিনী – পৌর টর্চার স্কোয়াড:
লিটনের শাসনামলে সৃষ্টি হয় ‘আকুল বাহিনী’ নামে এক ভীতিকর গোষ্ঠী। তাদের কাজ ছিল:
বিরোধীদের গুম-ধামকি
সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া কর্মীদের ওপর হামলা
টেন্ডার বিরোধীদের ঘরছাড়া করা
পৌর তহবিল থেকে মাসিক পৃষ্ঠপোষণা নেওয়া।
৭. বাণিজ্যে চাঁদাবাজি ও কমিশন রাজত্ব:
বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার পণ্য চলাচল করে। এই ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ ছিল লিটনের ‘সিন্ডিকেট রাজ’-এর হাতে।
ট্রাক পার্কিংয়ে চাঁদা, ক্লিয়ারিং হাউসে কমিশন, নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীদের ছাড় ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন।
৮. ফ্লাডলাইট প্রকল্প: দুদক তদন্তেও ব্যর্থতা
দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) একসময় ফ্লাডলাইট প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু স্থানীয় এমপি-নেতাদের হস্তক্ষেপে সেই ফাইল আর তদন্ত টেবিল ছাড়ায়নি।
“তদন্ত বন্ধ মানে অপরাধ নাই এই তো এখনকার বাস্তবতা।” একজন পৌর কর্মকর্তা।
৯. ভোট ডাকাতি ও নির্বাচনী সন্ত্রাস:
২০১৫ ও ২০২০ সালের পৌরসভা নির্বাচন ছিল ভয়ংকর। ভোটারদের বুথে যেতে বাধা, কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের মারধর—সবই ছিল ‘নতুন স্বাভাবিক’।
বিশেষভাবে আলোচিত—আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা সিরাজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আধিপত্য কায়েম করেন লিটন। এর পর তার ‘সমঝোতা প্রার্থিতা’ নিশ্চিত হয়।এক প্রকার ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে পৌরসভার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন তিনি।
অভিযোগসংক্রান্ত চিত্র:
বিষয় তথ্যসূত্র বর্তমান অবস্থা
ট্রাক টার্মিনাল দুর্নীতি নাগরিক কমিটি তদন্ত হয়নি
ভুয়া উন্নয়ন বিল স্থানীয় প্রতিবেদন অডিট অনুপস্থিত
সন্ত্রাসী বাহিনী যোগ রাজনৈতিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত
নাসির সেলটার সম্পর্ক বন্দর ইতিহাস প্রচলিত তথ্য
তুহিন হত্যা মামলা মামলা নথি তদন্তাধীন
আকুল বাহিনী মিডিয়া রিপোর্ট স্থানীয়ভাবে প্রমাণিত
আমদানি-রপ্তানি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ফোরাম তথ্যভিত্তিক অভিযোগ ফ্লাডলাইট দুর্নীতি দুদক সূত্র তদন্ত স্থগিত
ভোট ডাকাতি সংবাদ ও সাক্ষ্য ভয়াবহ নজির।
অনুসন্ধানী সুপারিশ:
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অডিট প্রকাশ
সকল টেন্ডার নথির স্বাধীন যাচাই
ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের জবানবন্দি
তুহিন হত্যা মামলার অগ্রগতি হালনাগাদ
আকুল বাহিনীর সদস্যদের নাম ও অর্থের উৎস খোঁজা
বন্দরের রাজস্ব ও কমিশন খাতের হিসাব পর্যালোচনা
পৌর নির্বাচনকেন্দ্রিক সন্ত্রাসের বিচারিক তদন্ত
মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের পৌর শাসন ছিল ‘জনগণের নয়, নিজের জন্য’। শহরের উন্নয়ন হয়নি, হয়েছে ব্যক্তিগত প্রাসাদতুল্য জীবন। শাসন ছিল ভয়ভীতির, প্রশাসন ছিল দুর্নীতির, আর জনগণ ছিল জিম্মি। এখন সময় এসেছে তদন্ত, জবাবদিহি ও বিচার নিশ্চিত করার—কারণ বেনাপোল শুধুই এক শহর নয়, এটা আমাদের সীমান্ত-বাণিজ্যের মুখপাত্র।